মুসলিম উত্তরাধিকার আইন
|
মুসলিম
উত্তরাধিকার আইন কনটেন্টটিতে উত্তরাধিকারের শ্রেণিবিভাগ, প্রাপ্ত সম্পত্তির
পরিমাণ, ত্যাজ্য সন্তানের উত্তরাধিকার, স্বামী-স্ত্রীর প্রাপ্ত সম্পত্তির পরিমাণ
সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন
আকরাম ৪০ বছর বয়সে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল। রেখে
গেল বাবা, স্ত্রী রেহানা, দুই ভাই ও এক মেয়ে মিতা। আকরাম কৃষিকাজ করত। তার প্রায়
১০ বিঘা জমি ও বসত বাড়ি ছিল। আকরামের মৃত্যুর পর আকরামের ভাই সাইদ আকরামের স্ত্রী
রেহানাকে বলে যে আকরামের সম্পত্তিতে রেহানা ও তার মেয়ে মিতার কোন অধিকার নেই। সাইদ
তাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। অসহায় রেহানা কি করবে বুঝতে পারে না। সে তার বাবার
বাড়িতে ফিরে আসে। রেহানার বাবা উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে জানত না। রেহানার বাবা
রেহানাকে নিয়ে উকিলের কাছে যান পরামর্শের জন্য। উকিল তাদেরকে উত্তরাধিকার আইন
সম্পর্কে অনেক তথ্য দেন।
উকিল
: মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী আকরামের সম্পত্তিতে রেহানা ও তার মেয়ে
মিতার অধিকার আছে।
রেহানা :
উত্তরাধিকার কি ?
উকিল : কোন
নারী বা পুরুষের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে মৃতের আনুষ্ঠানিকতা
সম্পাদনের খরচ, দেনাশোধ বা মৃতব্যক্তি যদি কোন উইল সম্পাদন করে যান তবে তা
হস্তান্তরের পর যে সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে তার উপর মৃতের সন্তান সন্তানাদি ও আত্মীয়
স্বজনের যে অধিকার জন্মায় তাকে উত্তরাধিকার বলে।
|
রেহানা :
উত্তরাধিকার আইন কি ?
উকিল : যে
নির্দিষ্ট আইন দ্বারা মৃতের সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টন করা হয় তাকে
উত্তরাধিকার আইন বলে।
রেহানা :
মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে উত্তরাধিকারীর শ্রেণীবিভাগ কিভাবে হয় ?
উকিল : মুসলিম
উত্তরাধিকার আইনে ৩ শ্রেনীর উত্তরাধিকার আছে। যেমন : অংশীদার, অবশিষ্টাংশ ভোগী,
দূরবর্তী আত্মীয়বর্গ।
রেহানা :
অংশীদার কারা ?
উকিল : যে
উত্তরাধিকারীদের অংশ কোরআনে নির্দিষ্ট করা হয়েছে তারাই অংশীদার।
রেহানা : অবশিষ্টাংশভোগী
কারা ?
|
উকিল : কোরআনে
নির্দিষ্ট অংশীদারদের সম্পত্তি বন্টনের পর মৃতের সাথে যাদের রক্তের সম্পর্ক রয়েছে
এবং অবশিষ্ট সম্পত্তিতে যাদের অধিকার রয়েছে তারাই অবশিষ্টাংশ ভোগী।
রেহানা : দূরবর্তী
আত্মীয়দের মধ্যে কারা সম্পত্তি পাবে ?
উকিল : যাদের সাথে
মৃতের রক্তের সম্পর্ক রয়েছে কিন্তু তারা অংশীদার বা অবশিষ্টাংশভোগী নয় তারাই মৃতের
দূরবর্তী আত্মীয়বর্গ। যদি মৃতের অংশীদার এবং অবশিষ্টাংশ ভোগী উত্তরাধিকার না থাকে
তাহলেই কেবল মৃতের দূরবর্তী আত্মীয়বর্গ সম্পত্তি পাবেন।
রেহানা : মুসলিম
উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী আমি কি সম্পত্তির উত্তরাধিকার ?
উকিল : মুসলিম
উত্তরাধিকার আইনে ৩ শ্রেণীর মধ্যে অংশীদারগণই প্রধান উত্তরাধিকার। কোরআনে
নির্ধারিত অংশ তাদেরকে দেয়ার পর যদি সম্পত্তি থাকে তবে তা অন্যদের মধ্যে বন্টন
করতে হবে অর্থাৎ অংশীদারগণ সকল উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অগ্রাধিকার পান। অংশীদারগণের
মধ্যে স্ত্রী অন্যতম। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে নিচের ৬ জন কোন অবস্থায়ই
উত্তরাধিকার হতে বাদ যায় না-
- পিতা
- মাতা
- ছেলে
- মেয়ে
- স্বামী
- স্ত্রী
উল্লেখ্য,
স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রী এবং স্ত্রীর অবর্তমানে স্বামী সম্পত্তি পাবেন।
রেহানা:
মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে আর কে কে অংশীদার আছেন?
উকিল:
মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে মোট ১২ জন অংশীদার আছেন। তাদের ৪ জন পুরুষ এবং ৮ জন নারী।
পিতা, মাতা, স্বামী, স্ত্রী, কন্যাসহ অন্যরা হলেন-দাদা, পুত্রের কন্যা, দাদী বা নানী,
আপন বোন, বৈমাত্রেয় বোন, বৈপিত্রেয় ভাই, বৈপিত্রেয় বোন।
রেহানা : মৃতের বাবা
কতটা সম্পত্তি পায় ?
উকিল : মৃত ব্যক্তির
পিতা উত্তরাধিকার লাভে তিন অবস্থায় পড়তে পারেন-
ক.
মৃত ব্যক্তির কোন পুত্র বা পুত্রের পুত্র, যত নিম্নেরই হউক, থাকলে বাবা ছয় ভাগের
এক ভাগ (১/৬) পাবেন।
খ.
পুত্র, পুত্রের পুত্র না থাকলে কিন্তু কন্যা, পুত্রের কন্যা থাকলে ছয় ভাগের এক ভাগ
( ১/৬) পাবেন এবং তাদের দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তাও
পাবেন।
গ.
মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান না থাকলে অন্যান্য অংশীদারদের দেয়ার পর বাকী সমস্ত
সম্পত্তি পিতা পাবেন।
রেহানা : মৃতের
মাতা কতটা সম্পত্তি পায় ?
উকিল : মৃত ব্যক্তির
মাতা তিনভাবে উত্তরাধিকার লাভ করতে পারেন-
ক.
মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি, যত নিম্নেরই হউক, থাকলে অথবা যদি
পূর্ণ, বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাই বা বোন থাকে তবে মাতা ছয় ভাগের এক ভাগ ( ১/৬)
পাবেন।
খ.
কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি, যত নিম্নের হউক না থাকলে এবং যদি একজনের বেশি
ভাই বা বোন না থাকে তবে মাতা তিন ভাগের এক ভাগ ( ১/৩)
পাবেন।
গ.
কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি, যত নিম্নের হউক না থাকলে অথবা কমপক্ষে দুইজন
ভাইবোন না থাকলে এবং যদি মৃত ব্যক্তি স্বামী বা স্ত্রী হয়, তবে তার স্বামী বা
স্ত্রী, মাতা ও পিতা উত্তরাধিকারী হলে সেই স্বামী বা স্ত্রীর অংশ বাদ দেয়ার পর যা
অবশিষ্ট থাকবে তার তিন ভাগের এক ভাগ ( ১/৩) মাতা পাবেন। মৃত
ব্যক্তির এক ভাই থাকলেও মাতা ১/৩ অংশ পাবেন।
রেহানা : স্বামী
স্ত্রীর সম্পত্তি কতটা পাবেন ?
উকিল : স্বামী স্ত্রীর
সম্পত্তি দুইভাবে পাবেন-
ক.
সন্তান বা সন্তানের সন্তান থাকলে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তির চারভাগের একভাগ (১/৪)
পাবেন।
খ.
যদি সন্তান বা সন্তানের সন্তান, যত নিম্নের হউক, না থাকে তাহলে স্বামী মোট
সম্পত্তির দুই ভাগের এক ভাগ (১/২) পাবেন।
রেহানা : স্ত্রী
স্বামীর সম্পত্তি কতটা পাবেন ?
উকিল : স্ত্রী স্বামীর
সম্পত্তি দুইভাবে পাবেন-
ক.
সন্তান বা পুত্রের সন্তান, যত নিম্নেরই হউক, থাকলে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির আট
ভাগের এক ভাগ (১/৮) পাবেন।
খ.
যদি সন্তান না থাকে তাহলে স্ত্রী মোট সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ (১/৪)
পাবেন। এখানে উল্লেখ্য, যদি মৃতের একাদিক স্ত্রী থাকেন তাহলে কোরআনে বর্ণিত অংশ
স্ত্রীদের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ হবে।
রেহানা : ছেলে
মৃত বাবার সম্পত্তি কতটুকু পাবেন ?
উকিল : মৃত ব্যক্তির
ছেলে / ছেলেরা সকল ক্ষেত্রেই সম্পত্তি লাভ করবেন। যেক্ষেত্রে মৃতব্যক্তির ছেলে ও
মেয়ে বর্তমান সেক্ষেত্রে ছেলে/ ছেলেরা, মেয়ে বা মেয়েদের দ্বিগুন সম্পত্তি
পাবেন। মৃতব্যক্তির সম্পত্তিতে পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী নির্দিষ্ট সম্পত্তি
পাওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি ছেলে মেয়ের মধ্যে বন্টন করা হবে। তবে মেয়ে না থাকলে
অংশীদারদের অংশ দেয়ার পর অবশিষ্টাংশভোগী হিসেবে বাকী সম্পূর্ণ সম্পত্তি ছেলে পাবে।
রেহানা : মেয়ে
মৃত বাবার সম্পত্তি কতটুকু পাবেন ?
উকিল : উত্তরাধিকারের
ক্ষেত্রে মেয়ে তিনভাবে সম্পত্তি পেতে পারেন-
ক.
একজন কন্যার অংশ দুইভাগের একভাগ (১/২)
খ.
একাধিক মেয়ে হলে সকলে মিলে সমানভাবে তিন ভাগের দুই ভাগ (২/৩)
পাবে।
গ.
যদি পুত্র থাকে তবে পুত্র ও কন্যার সম্পত্তির অনুপাত হবে ২:১ অর্থাৎ এক মেয়ে এক
ছেলের অর্ধেক অংশ পাবে।
রেহানা : কেউ যদি
সন্তানকে ত্যাজ্য করে তাহলে এই সন্তান কি সম্পত্তি পাবে ?
উকিল : মুসলিম
উত্তরাধিকার আইনে কোন সন্তানকে ত্যাজ্য করা যায় না। ফলে সম্পত্তি থেকে তাকে
বঞ্চিতও করা যায় না। তবে কোন ব্যক্তি রেজিস্ট্রিকৃতভাবে সম্পত্তি দান বা হস্তান্তর
করে গেলে এবং সন্তানকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে সন্তানের অংশ উল্লেখ না করে গেলে
ঐ সন্তান সম্পত্তি পাবে না।
উত্তরাধিকার
আইন সম্পর্কে জানার পর রেহানা তার অংশের সম্পত্তির দাবি করেন। সে আকরামের
সম্পত্তির ১/৮ বা ৩/২৪ অংশ
পায়, মিতা পায় সম্পত্তির ১/২ বা ১২/২৪
অংশ এবংবাবা অংশীদার হিসেবে ১/৬ বা ৪/২৪অংশ
ও অবশিষ্টাংশভোগী হিসেবে ৫/২৪ অংশ (বাবা মোট পায় ৯/২৪
অংশ)। বাবা থাকায় এক্ষেত্রে ভাইয়েরা কোন সম্পত্তি পায় নি। উত্তরাধিকার আইন
সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকার কারণে তারা তাদের সম্পত্তি পায়। এই সম্পত্তি থেকে
রেহানা বর্তমানে নিজেদের থাকা খাওয়ার খরচ ও মিতার পড়ালেখার খরচ করতে পারছে।
তথ্যসূত্র
- মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১।
- এ্যাডভোকেট শাহানা, দিলরুবা, মুসলিম আইনে উত্তরাধিকার, পৃষ্ঠা-৩১, নারী ও আইন, চতুর্থ সংস্করণ: ডিসেম্বর ১৯৯৩, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি।
- পারিবারিক আইনে বাংলাদেশের নারী, পৃষ্ঠা নং-৫২, প্রথম প্রকাশ: জুন-১৯৯৭, আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
- রহমান, মোহাম্মদ মজিবুর, মুসলিম ও পারিবারিক আইন পরিচিতি, পৃ: ১৬৫- ১৬৮, প্রথম সংস্করণ: মার্চ ১৯৮৯, বাদশাহ পাবলিশার্স, ঢাকা ।
- হোসেন, এস এম জাকির, নিত্যদিনের আইন, পৃ: ১৭- ২১, ডিসেম্বর ২০০৫, শ্রাবণ, ঢাকা।
সচরাচর জিজ্ঞাসা
প্রশ্ন ১. একজন মুসলিম নারী বা পুরুষকে কি সম্পত্তি থেকে
বঞ্চিত করার জন্য ত্যাজ্য করা যায় ?
উত্তর.
না, একজন মুসলিম নারী বা পুরুষকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা বা ত্যাজ্য
ঘোষণা করা যায় না।
প্রশ্ন ২. মৃত ব্যক্তির ছেলে না থাকলে মেয়ে কি সম্পূর্ণ
সম্পত্তি পাবে ?
উত্তর.
না, যদি মেয়ে সন্তান একজন হয় তবে মৃত ব্যক্তির মোট সম্পত্তির অর্ধেক পাবে (১/২),
একাধিক মেয়ে হলে মোট সম্পত্তির তিন ভাগের দুই (২/৩) ভাগ পাবে। তবে যদি মৃতব্যক্তি
জীবিত অবস্থায় মেয়েকে বা মেয়েদেরকে সম্পূর্ণ সম্পত্তি দান করে যায় তাহলে
মেয়েরা সম্পূর্ণ সম্পত্তি পাবে।
প্রশ্ন ৩. মেয়েরা কি মায়ের সম্পত্তি ছেলের চাইতে বেশি পায়
?
উত্তর.
না, মেয়েরা সবসময়ই ছেলের চাইতে অর্ধেক সম্পত্তি পাবে। মৃত ব্যক্তি মা বা বাবা যেই
হোক না কেন উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে একজন পুত্র, একজন কন্যার দ্বিগুন সম্পত্তি
পাবে।
প্রশ্ন ৪. সৎ ছেলে মেয়েরা কি বাবা-মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার
সূত্রে সম্পত্তি পাবেন ?
উত্তর.
না, কোন সৎ ছেলে-মেয়ে, সৎ বাবা-মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন না। এমন কি সৎ
বাবা-মাও সৎ ছেলে-মেয়ের সম্পত্তির উত্তররাধিকারী হবেন না।
No comments:
Post a Comment